ইঙ্ক
সন্তান লালনপালন মা-বাবার জন্য একটি গুরুদায়িত্ব। সন্তানের জন্মের পর থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবাই সন্তানের দেখাশোনা করেন। এ সময়টুকু অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মা-বাবা যেভাবে তাদের সন্তানদের গড়ে তোলেন, তা ভবিষ্যতে সন্তানের সাফল্য অর্জনের ওপর প্রভাব ফেলে।
তাই পিতামাতার উচিত এমনভাবে সন্তানদের গড়ে তোলা, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সফল হয়। বিভিন্ন গবেষণায় এমন কিছু অভ্যাসের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে, যেগুলো মা-বাবা মেনে চললে সন্তানের সফল হওয়ার পথ সুগম হয়। সেরকম সাতটি পরামর্শ এখানে জানানো হলো।
১. যেভাবে প্রশংসা করবেন
মা-বাবা সাধারণত যেভাবে তাদের সন্তানদের প্রশংসা করেন, তার কয়েকটি নমুনা হলো: তুমি খুব মেধাবী, তোমার মন অনেক দয়ালু, তোমার তো অনেক শক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এভাবে প্রশংসা না করে আরেকটু ভিন্নভাবে করা উচিত।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যারল ডুয়েকের গবেষণা অনুযায়ী, সন্তানের যেসব গুণ সহজাত সেগুলোর প্রশংসার চেয়ে যে গুণটি সন্তান নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করে, সেটির প্রশংসা করা বেশি কার্যকরী।
এছাড়া আরও অনেকগুলো গবেষণাতেই এ দাবির সপক্ষে প্রমাণ মিলেছে। তাই 'তুমি তো খুব ভালো আঁকো' না বলে 'আঁকার প্রতি তোমার আন্তরিকতা ও পরিশ্রম দেখে আমি মুগ্ধ আর ছবিটাও কী সুন্দর হয়েছে' এভাবে প্রশংসা করুন।
২. এ কাজটা আরও বেশি করে করুন
ব্রিহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটি'র এক গবেষণায় এলিমেন্টারি স্কুলে প্রশংসা ও সমালোচনা নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। এ গবেষণার জন্য গবেষকেরা টানা তিনবছর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন শিক্ষক যত ভেবেচিন্তে শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করেছেন, অন্যান্য ফ্যাক্টর থাকা সত্ত্বেও তারা তত বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছে। ওই গবেষণার মূল লেখক পল ক্যালডারেলা বলেন, 'যত বেশি প্রশংসা, তত ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।'
অবশ্য এটা শ্রেণিকক্ষের পর্যবেক্ষণ, বাড়ির নয়। তারপরও নিজেও ভেবে দেখুন, গঠনমূলক প্রশংসা বা সমালোচনা শুনলে আপনিও সময়ে সাথে সাথে আরও শ্রেয়তর সাড়া দিন কিনা।
৩. সন্তানদের দিয়ে কাজ করান
ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাটির নাম হার্ভার্ড গ্রান্ট স্টাডি। এ গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের সুখী ও সফল হওয়ার জন্য দুটো মূল বিষয়ের প্রয়োজন রয়েছে। একটি হচ্ছে ভালোবাসা, ও অন্যটি কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা।
কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জনের জন্য ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদেরকে 'কাজ করার মানসিকতা' গড়ে তুলতে হবে। আর সেটা করার জন্য সন্তানদের দিয়ে ঘরের কিছু ছোটখাটো কাজ করিয়ে নিতে হবে।
এতে অল্প যে অসুবিধাটি হতে পারে তা হলো, বাচ্চাদের কাজ খুব একটা ভালো হয়না। যেমন বাচ্চাদের ঘর মুছতে দেওয়া হলে তারা যে পরিমাণ কসরত আর সময় খরচ করবে, তার চেয়ে অনেক সহজে ও দ্রুত আপনি সেটা করতে পারবেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজটা তাদের দিয়েই করান। এটা কেবল পরিষ্কার মেঝের সাথে জড়িত নয়, বরং এর মাধ্যমে বাচ্চা শিখতে পারবে কীভাবে একটি সুখী জীবন অর্জন করা যায়।
৪. বাচ্চাদের সমর্থন যোগান
মা-বাবারা একটি বিষয় নিয়ে প্রায়ই ধন্দে ভোগেন। সন্তান পড়ে গেলে কি গিয়ে তোলা উচিত নাকি তাকে নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে বলা উচিত যেন সে স্বাবলম্বিতার শিক্ষা পেতে পারে? একইভাবে সন্তান বড় কোনো ভুল করলে, কোনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে তাকে সমর্থন যোগানো উচিত নাকি দূরে দূরে থাকা উচিত, এসব নিয়েও দুবার ভাবেন পিতামাতা।
অনেকগুলো গবেষণার জরিপ থেকে এ নিয়ে একটিই উত্তর পাওয়া গিয়েছে। আর সেটা হলো সন্তানকে সমর্থন জানান, তাদেরকে সান্ত্বনা প্রদান করুন।
তার মানে সন্তানের সব সমস্যা নিজে সমাধান করে দেবেন না। বরং সমানুভূতি (এমপ্যাথি) দিয়ে তাদের পাশে থাকুন। গবেষণায় আরও দেখা দেছে, যাদের মা-বাবা তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, সেসব মানুষ সামাজিকভাবে অনেক বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
৫. সন্তানের সামাজিক দক্ষতার ওপর মনোযোগ দিন
এ কাজটা মা-বাবারা এমনিতেই করে থাকেন। জেএএমএ পেডিয়াট্রিক্স নামক একটি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ার সময় যারা 'সামাজিতায় দক্ষ' ছিলেন, তার সঙ্গে তাদের ৩০ বছর পরে আর্থিক সাফল্যের সহসম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে।
এ গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত একজন গবেষক জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন সন্তানের সামাজিকতায় সীমাবদ্ধতা থাকলে এবং তা সমাধানে কাজ করলে ভবিষ্যতে সন্তানের আর্থিক ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক সুফল পাওয়া যায়।
আর, সন্তান সচ্ছল জীবনযাপন করুক, কোন মা-বাবা সেটা চান না।
৬. স্মরণ করিয়ে দিন উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা
সন্তানের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধারণ করুন, তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে তা স্মরণ করিয়ে দিন।
যুক্তরাজ্যের ১০ বছর ধরে ১৫ হাজার তরুণীর ওপর চালানো এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব বাচ্চাদের মা-বাবা 'তাদেরকে রীতিমতো তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন' সেসব বাচ্চাদের বড় হয়ে দীর্ঘসময় ধরে বেকার থাকতে হয়নি; অপছন্দের, কম বেতনের চাকরিতে যোগ দিতে হয়নি; কলেজের পাঠ চোকানো সম্ভব হয়েছিল; এবং কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ করতে হয়নি।
৭. অর্থের ভূমিকা
আমেরিকান সোশিওবায়োলজিক্যাল রিভিউ নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ধনী পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের জন্য কীভাবে অর্থ ব্যয় করে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, সন্তানদের কথা বিবেচনা করে এসব পরিবারগুলো বনেদি এলাকায় বাস করতে শুরু করেন।
সন্তান লালনপালনে অর্থকড়ি একমাত্র প্রভাবক নয়, তবে এ কাজে অর্থ, শ্রেণি, এমনকি বংশ বা জাতও যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, সে কথাও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না।